বিশ্বরাজনীতির চাপে পড়ে নানা অঘটনের জন্ম দেওয়া ১৯৫০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আদ্যোপান্ত

 

উরুগুয়ের গিগিয়ার করা সেই বিখ্যাত গোলের মুহূর্ত ছবি-সিএনএন

সাল ১৯৫০ ফুটবলের ইতিহাসে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণীয় বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ব্রাজিলে। ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ সালের দুটি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে পারেনি বিশ্বযুদ্ধের কারনে। ফিফা দ্রুত চেয়েছিলো ফুটবলে প্রান সঞ্চার করতে। সেজন্য প্রয়োজন ছিলো বিশ্বকাপ আসর। যুদ্ধের কারনে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো তখন ব্যস্ত ছিলো সংস্কার কাজে। ব্রাজিল ফিফা মিটিংয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তাব দেয়। জুলে রিমের ফিফা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২৫ বছর পুর্তি উপলক্ষে বিশ্বকাপ ট্রফির নামকরন করা হয় জুলে রিমে ট্রফি। স্বাগতিক দেশ নির্ধারণের পর ফিফার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায় বিশ্বকাপের দল নির্বাচন করা। স্বাগতিক দেশ হিসেবে ব্রাজিল নিশ্চিত। আগের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ইতালির খেলা নিয়ে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। ১৯৪৯ সালের ৪ মে বিমান দুর্ঘটনায় ইতালির জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় নিহত হয়। ইতালির এয়ার ফোর্সের একটি বিমানে ৩১ জন মানুষ সবাই নিহত হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত  বিশ্বকাপ খেলতে রাজি হয় তবে তারা বিমানে না এসে জলপথে ভ্রমন করে ব্রাজিল আসে ইতালি দল।

স্বাগতিক ও চ্যাম্পিয়ন ছাড়াও আরও বাকি থাকে ১৪ টি দল। বাছাই পর্বের আগে থেকেই ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে ছায়া ফেলে বিশ্বরাজনীতির কালো ছায়া। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভূমিকার কারণে জার্মানি ও জাপানকে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের বাইরে রাখে ফিফা। সারল্যান্ড বিতর্কের কারনে এই বিশ্বকাপে রাখা হয়নি ফ্রান্সকে।

ইংল্যান্ড ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবার অংশগ্রহন করে। সিদ্ধান্ত হয় ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়নশীপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সাআপ দল বিশ্বকাপের টিকিট পাবে। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইংল্যান্ড এবং রানার্স আপ দল হিসেবে স্কটল্যান্ড খেলার সুযোগ পাবে। আয়রন কার্টেনের কারনে বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন।

এখানেই শেষ নয় বাছাই পর্বের ড্র অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বেঁকে বসে আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর এবং পেরু। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ল্যাটিন আমেরিকা থেকে খেলার টিকিট পায় উরুগুয়ে, চিলি,বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে। এশিয়া থেকে  ৪টি দেশ বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব খেলার কথা থাকলেও ফিলিপিন্স, ইন্দনেশিয়া, বার্মা নাম প্রত্যাহার করে নেই। বিশ্বকাপে খেলার জন্য নির্বাচিত হয় ভারত। দল খুব দূর্বল এই কারন দেখিয়ে নাম প্রত্যাহার করে অস্ট্রিয়া । একই পথে হাঁটে বেলজিয়াম। সেকারণে বাছাইপর্ব না খেলেই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে সুইজারল্যান্ড ও তুরস্ক।

বিশ্বকাপে ১৬ টি দল চূড়ান্ত হওয়ার পর আবার বিপত্তি বাধে। স্কটল্যান্ড ফুটবল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান জর্জ গ্রাহাম বলেন ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়নশীপের চ্যাম্পিয়ন হলেই কেবল ব্রাজিল বিশ্বকাপে অংশগ্রহন করবে। কিন্তু স্কটল্যান্ড রানার্স আপ হওয়ায় স্ক্লটল্যান্ড দলকে ব্রাজিল না পাঠানোর সিদ্বান্ত নেন তিনি। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে তুরস্ক বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেই। জায়গা পুরনের জন্য ফিফা পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড এবং ফ্রান্সকে আমন্ত্রন জানায়। পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড ফিফার আমন্ত্রনে সাড়া দেয়নি। ফ্রান্স বিশ্বকাপে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেও ড্রয়ের পর নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ফিফাকে ১৩ টি দল নিয়েই বিশ্বকাপ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রাজিল প্রস্তাব দেয় চারটি গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন দলগূলো রাউন্ড রোবিন লীগ পদ্ধতিতে খেলবে। এতে করে খেলার সংখ্যা বেশি হবে। যাতে আর্থিক খরচ ব্রাজিল কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারে।

 

ভারত ট্রাজেডি:

1948 অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে ভালো ফুটবল খেলে ভারত। ফ্রান্সের কাছে ২-১ ব্যবধানে হারলেও ৭০ মিনিট পর্যন্ত ১-১ গোলে সমতা ধরে রাখে। সেই খেলায় ভারতের বেশির ভাগ ফুটবলার খালি পায়ে খেলেছিলেন বাকিরা মোজা পায়ে খেলেছিলেন। ড্র এর পর ভারত নাম প্রত্যাহার করে নেয়। ভারতের বিশ্বকাপ না খেলার পিছনে বিভিন্ন রকম থিওরি আছে। অনেকেই বলেন খালি পায়ে খেলতে চেয়েছিলো ভারত কিন্তু ফিফা রাজি না  হওয়ায় তারা খেলতে যায়নি। অনেকেই মনে করেন ভারত থেকে ব্রাজিল অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় বিপুল খরচের কারনে যায়নি। তবে ফিফা ভারতের যাতায়াত খরচের বেশিরভাগ দিতে রাজি হয়েছিলো। তখন ভারতীয় ফুটবল এসোসিয়েশন জানাই তাদের দল নির্বাচনে জটিলতা আছে, পর্যাপ্ত অনুশীলন হয়নি তাই ভারত খেলতে যেতে পারবে না। ওই সময়ের ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক শৈলেন মান্না মনে করতেন বিশ্বকাপ আমাদের কাছে অতটা গুরুত্বপুর্ণ নয় অলিম্পিকটাই আসল আমাদের কাছে । দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশ বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছিলো ভারত প্রথম ঐ একবারই।

 

ম্যাচ অফ মিরাকলঃ

অন্যতম ফেবারিট দল হিসেবে বিশ্বকাপ খেলতে আসে ইংল্যান্ড।অবশ্য সেবারই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে আসে। ইউরোপে সেই সময় ইংল্যান্ড খুব ভালো টিম ছিলো। তাদেরকে বলা হতো ‘কিন্স অব ফুটবল’। বিশ্বকাপ পর্যন্ত তাদের খেলার পরিসংখ্যান হলো ২৩ টি জয় ৩টি ড্র এবং ৪টি হার। বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে অবশিষ্ট ইউরোপ একাদশকে ৬-১ ব্যাবধানে হারায় ইংল্যান্ড। অন্যদিকে যুক্ত্ররাষ্ট্রের ফুটবল তখন পর্যন্ত পুরোপুরি পেশাদার হয়ে উঠতে পারে নাই। ফুটবলাররা খেলার পাশাপাশি অন্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। তাই যুক্ত্ররাষ্ট্রকে কত গোলের ব্যবধানে হারাতে পারবে ইংল্যান্ড তাই দেখার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে ছিলো। বেলো হরিজন্তের মাঠে প্রায় ১০ হাজারের বেশি দর্শক হাজির হয় ইংল্যান্ডের গোল উতসব দেখতে। যুক্ত্ররাষ্ট্রের কোচ আগের দিন বলেন আমাদের কোন চান্স নেই। ইংলিশ পত্রিকা দৈনিক ডেইলী এক্সপ্রেস লিখেছিলো যুক্ত্ররাষ্ট্রের নামের পাশে আগেই ৩ টি গোল দিয়ে দিলে ভালো হয়। কিন্তু বিধিবাম সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ম্যাচে হেরে যায় ইংল্যান্ড ইতিহা্স রচনা করে যুক্ত্ররাষ্ট্র। খেলার ৩৮ মিনিটে একমাত্র গোলটি করেন জো গাইতেন্স। শুধু এই ম্যাচ নিয়ে বই লেখা হয়েছে।  জিওফ্রি ডগলাস এর বইয়ের নাম ‘দ্য গেম অফ দেয়ার লাইভস’। পরে যেটি নিয়ে চলচ্চিত্র  নির্মান করা হয় ‘দ্য মিরাকল ম্যাচ’।

 

মারাকানাজো (মারাকানা ট্রাজেডি):

1950 সালের ১৬ জুলাই বিশ্বকাপের ফাইনাল রাউন্ডের শেষ ম্যাচ। শিরোপা উতসব করার জন্য প্রস্তুত ব্রাজিল। সামনে প্রতিপক্ষ প্রতিবেশী দেশ উরুগুয়ে। তাদের চেয়ে ব্রাজিল ১ পয়েন্টে এগিয়ে । ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। অন্যদিকে উরগুয়েকে জিততেই হবে। ম্যাচের আগে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার উদযাপন প্রায় শুরুই করে দিয়েছে ব্রাজিল। সংবাদ মাধ্যমগুলো আগের দিন ব্রাজিলকে এক প্রকার চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেই দিয়েছিলো। রিও ডি জেনেরিও এর মেয়র ব্রাজিল দলকে বরণ করার জন্য ২২ টি সোনার মেডেলও প্রস্তুত রেখেছিলেন। ব্রাজিল জেতার পর একটি বিজয় সংগীত গেয়ে তা উদযাপন করা হবে। ‘ দ্য ভিক্টরস’ নামেসেই বিজয় সংগীত কম্পোজ করে কয়েকবার অনুশীলন করা হয়। ব্রাজিল দলের হাতে ট্রফি হাতে উদযাপন দেখতে মারকানায় প্রায় ২ লাখ মানুষ হাজির হয়।

অন্যদিকে উরুগুয়ে তারা মনে করে তারা আন্ডারডগ তাদের হারানোর কিছু নেই। তারা তাদের খেলায় কৌশল পরিবর্তন করে। ম্যাচে ব্রাজিল সম্পূর্ণ সাদা জার্সি গায়ে দিয়ে খেলতে নামে। তখনো ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সির জন্ম হয়নি। আর উরুগুয়ে নামে তাদের ঐতিহ্যবাহী আকাশী নীল জার্সি আর কালো শর্ট পরে। ব্রাজিল একাদশ সাজায় ৩-৪-৩  ফরম্যাশনে। আর উরুগুয়ে সাজায় ৪-৩-৩ ফরম্যাশনে। প্রথমার্ধ গোলশুন্য থাকে। বিরতির পর ব্রাজিলের  দর্শকদের আনন্দের মাত্রাকে সাত আসমানে চড়িয়ে ব্রাজিলকে এগিয়ে  দেন ফ্রিয়াকো। ৬৬মিনিটে উরুগুয়েকে সমতায় আনেন শিয়াফিনো।  কিন্তু তখনো ব্রাজিল সমর্থকরা খুব একটা হতাশ হননি। খেলার যখন ১১ মিনিট বাকী তখন দর্শকদের স্তব্ধ করে দেয় আলসাইদিস গিগিয়ার একটি দৌড়। উরুগুয়ের স্ট্রাইকার গিগিয়া মাঠের ডান প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে দৌড় দিয়ে  ব্রাজিলিয়ান গোল রক্ষককে পরাস্ত করে। উরুগুয়ে এগিয়ে যায় ২-১ গোলে। রেফারির শেষ বাশি বাজার আগে স্কোর লাইনে কোন পরিবর্তন আসেনি। ব্রাজিলিয়ানদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে। অনেক ভক্ত এই এই বিষাদ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। বিখ্যাত রেডিও সাংবাদিক আরো বারাসো অবসর নিয়ে নেন। ব্রাজিল দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় মানুসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন।

 

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ