![]() |
গ্রামের ছেলেদের দাড়িয়াবাধাঁ খেলার একটি দৃশ্য ছবি- নয়া দিগন্ত |
দাড়িয়াবাধাঁ বা দাড়িয়াবান্ধা খেলা বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলের
মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও সুপরিচিত খেলা। গ্রামের ছেলেরা শীতের বিকেলে দল বেঁধে নেমে পড়েন
এই খেলা করতে। অনেক সময় মেয়েদেরকেও এই খেলা করতে দেখা যায়। ব্যাপক জনপ্রিয়তার জন্য
এখনো মাঝে মাঝে গ্রামে এই খেলা চোখে পড়ে। শহর অঞ্চলে এই খেলা খুব কম দেখা যায় কারন
এই খেলার জন্য যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো উন্মুক্ত জমি বা পতিত জমি যেটা
গ্রাম অঞ্চল ছাড়া মেলা ভার। এক খন্ড পতিত জমি যা রুপান্তরিত হয় দাড়িয়াবাধা খেলার
কোর্টে।
গ্রামে ফসল কাটার পর প্রচুর খালি জমিপড়ে থাকতে দেখা যায় ফলে খেলার মাঠের
অভাব হয় না। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে এই খেলার প্রচলন বেশি দেখা যায়। শহরের আধুনিক
অন্য খেলার ভিড়ে এই খেলার তেমন কোন স্থান বললেই চলে। তাছাড়া
দারিয়াবাধাঁ খেলার প্রচারও কম। বর্তমান সময়ের
অনেকেই এই খেলার নামও জানে না।
প্রাচীনকাল থেকেই এই খেলার প্রচলন গ্রাম বাংলায় রয়েছে বলে জানা যায়। এই
খেলার নিয়ম কানুন স্থান বা এলাকা ভেদে কিছুটা ব্যতিক্রম থাকলেও মোটামুটি সবাই
প্রায় একইভাবে খেলে থাকেন।
দারিয়াবাধাঁ খেলার জন্য প্রথম প্রয়োজন একটি খোলা মাঠ । সাধারনত এই খেলা
সারা বছর খেলা হয় না বলে এর কোন নির্দিষ্ট মাঠ থাকে না। ফসল কাটার পর পড়ে থাকা জমি
এই খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই মাঠে কোর্ট কাটা হয়। এই কোর্টের একটা
নির্ধারিত পরিমাপ রয়েছে যদিও গ্রাম অঞ্চলে সবসময় এটি রক্ষা করা সম্ভব হয় না। কোর্ট
হবে লম্বায় ৮০ ফুট এবং চওড়ায় ২১ ফুট। কোর্টের ঠিক মাঝখান দিয়ে ১ ফুট চাওড়া একটি ঘর
দ্বারা কোর্টকে বিভক্ত করা হয়। এই লম্বা দাগকে বলা হয় কেন্দ্রিয় দুর্গ বা শির।
আবার কোথাও কোথাও একে সুর বলা হয়
কোর্টের ৮০ ফুট লম্বাকে আড়াআড়ি দাগ কেটে ১১ ফুট দাগ কেটে একটি করে ঘর করতে
হয়। এই ঘর গুলিকে বলা হয় দূর্গ বা পাতি। পাতিগুলো হবে আয়তাকার। সুর ও দুর্গের
সংযোগস্থলে ১৬ ইঞ্চির একটি বর্গাকৃতির ঘর থাকবে।
কোর্টের দুইপাশে লম্বারেখাদ্বয়কে বলা হবে সাইডলাইন। যা ২ ইঞ্চি চওড়া হয়।
খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনুসারে দুর্গ হবে ৭ থেকে ৯। প্রয়োজনে এই সঙ্খ্যা আরো বাড়ানো
যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কোর্টও লম্বায় বাড়াতে হবে। তবে চওড়ায় ২১ ফুটের কম বেশি করা
যাবে না । প্রথম দুর্গকে বলা হয় সম্মুখ দূর্গ বা কালাপাতি আর শেষের দূর্গকে বলা পশ্চাদ দুর্গ বা লোনাপাতি। মাঝামাঝি যে ১ ফুটের যে লম্বা দূর্গ শেষ পর্যন্ত চলে গেছে
তাকে বলা হয় কেদ্রিয় দূর্গ বা সুরপাতি।
খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৭ থেকে ৯ জন থাকবে। কোর্ট ছোট বড় করায় এই সঙ্খ্যা কম বেশি
হতে পারে। এই খেলা দুটি দলের মধ্যে হয়ে থাকে। জার্সি ব্যবহার করার নিয়ম থাকলেও
গ্রাম অঞ্চলে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। টসের মাধ্যমে নির্ধারন
করা হয় কোন দল আগে আক্রমন করবে আর কোন দল রক্ষনকারীর ভূমিকা পালন করবে। আক্রমনকারী
দলের কাজ হবে প্রতিপক্ষ দলকে ফাকি দিয়ে এক্টারর পর একটা ঘর অতিক্রম করে যাওয়া। আর
রক্ষণকারী দলেরর কাজ হচ্ছে আক্রমনকারঈ দল্কে প্রতিহত করা অর্থাৎ ঘর বা দূর্গ
অতিক্রম করতে না দিয়ে আটকে রাখা। নিজ দুর্গ রক্ষা করা।
রক্ষণকারী দল নিজ নিজ দুর্গে অবস্থান নেওয়ার
পর রেফারি বাঁশি দিয়ে খেলা শুরু করবেন। রক্ষকদের বলা হয় পাতিয়াল। আক্রমন কারী দলের
খোলোয়াড়্ররা রক্ষনকারীদলের খেলোয়াড় অর্থাৎ পাতিয়ালদের ছোঁয়া বাচিয়ে কোর্টের শুরু থেকে
শেষের দিকে যেতে থাকবেন। যখন আক্রমন কারী খেলোয়াড়রা শেষের দিকে যেতে থাকবে তখন তাদেরকে
বলা হবে কাঁচা খেলোয়াড়। বার যখন তারা কোর্টের শেষ
প্রান্ত অতিক্রম করার পর আবার তারা
উপরের দিকে উঠতে শুরু করবে তখন তাদের বলা হবে পাঁকা খেলোয়াড়। আক্রমনকারী দলের
যেকোন একজন প্লেয়ার জীবন্ত অবস্থায় পাকা হয়ে
আবার শুরুর স্থানে অর্থাৎ স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরে আসতে পারলে এক গেম হবে। অর্থাৎ আক্রমনকারী
দল বিপক্ষ দলকে এক গেম দেবে বা এক গেমে এগিয়ে যাবে।
অপরদিকে পাতিয়াল বা রক্ষণকারী দলের কোন খেলোয়াড় যদি ১৬ ইঞ্চি দাগের মধ্যে থেকে কোন আক্রমনকারী দলের একজনকে ছুঁইয়ে দিতে বা স্পর্শ করতে পারে তাহলে আক্রমনকারি দলের সবাই মারা যাবে বা আউট হবে। ফলে রক্ষনকারী দল আক্রমনের সুযোগ পাবে বা তারাই হবে আক্রমনকারী দল। একইসাথে পূর্বের আক্রমনকারী দল হয়ে যাবে রক্ষনকারী দল। খেলার নির্দিষ্ট সময় থাকে। নির্দিষ্ট সময় শেষ হলে যে দল বেশি গেম দিতে পারে সে দলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। যদিও গ্রাম অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময় বলে কিছু থাকে না। বিকালে শুরু হয়ে সন্ধ্যা অবধি চালিয়ে যায় বা যতক্ষণ তাদের খুশি খেলা করতে থাকে।
খেলা চলাকালে কোন
পাতিয়াল কোন ক্রমেই তার দুর্গ পরিবর্তন করতে পারবেন না। সুরপতি বা কেন্দ্রীয় দুর্গ
রক্ষক সামনে পেছনে গিয়ে যেকোন খেলোয়াড়কে আউট করতে পারে। প্রত্যেক দুর্গের আলাদা আলাদা
নাম রয়েছে। যেমন প্রথম দুর্গ, দ্বিতীয়্ দুর্গ, তৃতীয় দুর্গ প্রভৃতি। পাতিয়ালরা তার দুর্গের যেকোন পাশে গিয়ে আক্রমনকারীকে
আউট করতে পারে।
আজ ক্রিকেট,ফুটবল, ব্যাডমিন্টন,
হকির ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য দাড়িয়াবাধা খেলা। তবে নতুন
প্রজন্মের কাছে দাড়িয়াবাধা খেলা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলে হয়তো বিলুপ্তির হাত থেকে
রক্ষা পেতে পারে গ্রাম বাংলার এই জনপ্রিয় খেলা দাড়িয়াবাধাঁ বা দাড়িয়াবান্ধা খেলা।
0 মন্তব্যসমূহ